বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রাজশাহী বিভাগকে বলা হয় "আমের রাজধানী"। এই অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু ও কৃষি সংস্কৃতি আম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে রাজশাহীর আম দেশজুড়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। রাজশাহীর আমের খ্যাতির কারণ, বিখ্যাত আমের জাত, আম চাষের ইতিহাস ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন : সূরা আল-আন-আমের ফজিলত
রাজশাহীর মাটি আম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। এই অঞ্চলের মাটি দোআশ ও বেলে দোআশ প্রকৃতির, যা আম গাছের শিকড়ের জন্য ভালো বায়ু চলাচল এবং পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করে। এছাড়াও, এই অঞ্চলের উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু আমের স্বাদ ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে। গ্রীষ্মকালে প্রচুর রোদ্র এবং শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া আম গাছের ফুল ও ফল ধারণে সহায়তা করে।
রাজশাহীতে আম চাষের ইতিহাস শতাব্দী প্রাচীন। ব্রিটিশ ও মুঘল আমল থেকেই এই অঞ্চলে উন্নত মানের আমের চাষ হয়ে আসছে। স্থানীয় কৃষকরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে আম চাষের বিশেষ কৌশল রপ্ত করেছেন, যা আমের গুণগত মান বজায় রাখে।
রাজশাহী অঞ্চলে সেচের জন্য পদ্মা ও অন্যান্য নদীর পানি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) এবং রাজশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মাধ্যমে এখানে উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী আমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আর পড়ুন : এক বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে তিন বন্ধুর বাসর
রাজশাহীতে প্রায় ১৫০ রকমের আমের চাষ হয়, যার মধ্যে কয়েকটি জাত দেশ-বিদেশে বিশেষভাবে সমাদৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
(ক) ফজলি আম
ফজলি আম রাজশাহীর সবচেয়ে বিখ্যাত আম। এটি মিষ্টি, রসালো ও সুগন্ধিযুক্ত। এই আমের আকার বড় এবং এটি সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে পাকে।
(খ) ল্যাংড়া আম
এই আমের স্বাদ অনন্য এবং এর শাঁস নরম ও আঁশবিহীন। ল্যাংড়া আমের গাছ বেশি উঁচু না হওয়ায় এটি চাষে সুবিধাজনক।
(গ) গোপালভোগ আম
মাঝারি আকারের এই আমটি খুব মিষ্টি এবং এর গন্ধ অতুলনীয়। এটি সাধারণত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে আসে।
(ঘ) হিমসাগর আম
এই আমটি অত্যন্ত রসালো এবং এর স্বাদ মিষ্টি ও টক-মিষ্টি। এটি রাজশাহীর পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জেও প্রচুর চাষ হয়।
(ঙ) আম্রপালি ও বারি আম-৪
এগুলো উচ্চ ফলনশীল সংকর জাতের আম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) উদ্ভাবিত এই আমগুলো দ্রুত বর্ধনশীল এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক।
রাজশাহীর আম শুধু স্থানীয় বাজারে নয়, সারাদেশে এবং বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার টন আম ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে রাজশাহীর আম রপ্তানি হয়, যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
আম চাষ, সংগ্রহ, পরিবহন, প্যাকেজিং ও বিপণনের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। আমের মৌসুমে অসংখ্য শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়।
রাজশাহীতে আমের বাগানগুলো পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। অনেকেই আম পাড়া উৎসবে অংশ নিতে বা বাগান পরিদর্শন করতে রাজশাহীতে আসেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে সহায়তা করে।
রাজশাহী তার উৎকৃষ্ট মানের আমের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি এবং কৃষকদের পরিশ্রম এই সাফল্যের মূল কারণ। আম শুধু একটি ফল নয়, এটি রাজশাহীর অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গবেষণা ও বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটলে রাজশাহীর আম বিশ্বব্যাপী আরও বেশি স্বীকৃতি পাবে।
0 মন্তব্যসমূহ